-

ভয়েজার ১: একটি এক্সট্রা-অর্ডিনারি মহাকাশ অনুসন্ধান যন্ত্রের গল্প।

একটা জিনিস কল্পনা করুন,মানুষ নির্মিত কোনো যন্ত্র আমাদের সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে মিল্কওয়ে গ্যালাক্সির বিশালতায় ডানা মেলেছে এবং এখনো সেটি তার ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছে।ব্যাপারটি খুবই রোমাঞ্চকর না?? আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে ভয়েজার ১ এই কাজটি ২০১২ সালেই সম্পন্ন করে ফেলেছে!! ২০১৮ পর্যন্ত এটি প্রায় ২১ বিলিয়ন কিলোমিটার বা ১৩ বিলিয়ন মাইল দুরত্ব পাড়ি দিয়েছে এবং এখনো সেকেন্ড প্রায় ঘন্টায় ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটছে। আর এই তের বিলিয়ন মাইল দুরত্ব অতিক্রম করতে সময় লেগেছে কত জানেন?? প্রায় ৪০ বছর ছয় মাস!! সেই ১৯৯৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে ভয়েজার ১ এবং এর যমজ ভয়েজার ২ রওনা দেয় এর ষোল দিন আগে।কিন্তু দুরত্বের দিক দিয়ে এটি বাকি সবাইকে ছাপিয়ে যায় এবং মানুষ নির্মিত প্রথম বস্তু হিসেবে সৌরজগতের সীমানা পার করতে সক্ষম হয় এবং এটি এখন পর্যন্ত মানুষ নির্মিত সবচেয়ে দুরতম বস্তুও বটে! চলুন জেনে নেওয়া যাক এই এক্সট্রা অর্ডিনারি যন্ত্রের এক্সট্রা অর্ডিনারি ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত গল্প-



উদ্যেশ্য ও যাত্রা: ভয়েজার মিশনের সম্পুর্ন দায়িত্ব পালন করে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি।প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল শনি এবং বৃহস্পতি গ্রহেকে পর্যবেক্ষণ করা। ভয়েজার ২ বাড়তি হিসেবে ইউরেনাস ও নেপচুনকেও অতিক্রম করতে সমর্থ হয়।এটি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহগুলোর কিছু দুর্দান্ত ছবি এবং ভিডিও পাঠায়। ভয়েজার ১কে তৈরি করা হয়েছিলো আরো বেশিই অ্যাডভান্স করে। সেটি সৌরজগতে তার সকল লক্ষ্য পুরন করে এগিয়ে যায় আরো বেশি দুরে। ২০১২ এর আগস্টে ভয়েজার এক সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করে এবং ঐতিহাসিক ইন্টারস্টেলার জার্নি শুরু করে। এতসব অর্জন কিন্তু কয়েকদিনেই হয়নি, প্রায় ৪০ বছরের যাত্রায় এসব সম্ভব হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এতগুলো বছরে ভয়েজার পর্যাপ্ত জ্বালানি পেল কই?? কিভাবেই বা এতগুলো পথ পাড়ি দিল? তাই আগেই বলে রাখি এটি পরিচালিত হয় পারমাণবিক শক্তির দ্বারা। এর ভিতরে রাখা আছে তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম, এবং এখনো এতে প্রায় ৭০ পার্স্টেন্টের মতো প্লুটোনিয়াম অবশিষ্ট আছে। তো আমরা এর প্রাথমিক যাত্রা সম্পর্কে জানবো এখন-

চিত্র: টাইটান IIIE রকেট দ্বারা ভয়েজার ১ এর উৎক্ষেপন।

ভয়েজার ১ উৎক্ষেপন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কেপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে। ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে। ব্যাবহৃত রকেটটি ছিল একটি Titan IIIE এবং এটি পরিচালিত হয় নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি দ্বারা। পাইয়োনিয়ার ১০ নামের আরেকটি প্রোব আগে পাঠানো হয়েছিলো।পাইয়োনিয়ার থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমুহ থেকে বিজ্ঞানীরা ভয়েজার মিশনটি আরো নিখুঁত করে গড়ে তোলেন।

গঠন: ভয়েজার তখনকার সময়ের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির দ্বারা তৈরি করা হয়েছিলো, যদিও বর্তমান প্রযুক্তির থেকে এটি কয়েকগুন পিছিয়ে রয়েছে।

চিত্র:ভয়েজার ১ এর মুল অংশগুলো।

এর আকৃতি অনেকটা UFO এর মতো। উপরে আছে একটি বড় অ্যান্টেনা। একপাশে ক্যামেরা এবং অন্যপাশে শক্তি উৎপাদনকারি জেনারেটর যা তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম থেকে শক্তি উৎপাদন করে। তারার অবস্থান এবং মহাজাগতিক রশ্মি চিহ্নিত করার জন্য এতে কিছু সেন্সর রয়েছে তবে তা খুবই পুরনো প্রযুক্তির। ভয়েজার ১ এ আরো যেসব অবাক করা জিনিস আছে তা হলো-
১। পৃথিবীর ১১৬টি ছবি। যদি কোনদিন এটি অন্যকোন সোলার সিস্টেমে বসবাসযোগ্য কোনো গ্রহ এবং এলিয়েন খুজে পায় তবে তারা যেন জানতে পারে যে তারাই মহাবিশ্বে একমাত্র প্রানি নয়!!
২। একটি স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া সিডিতে রেকর্ড করা বাচ্চা মেয়ের কন্ঠে রেকর্ড করা বাক্য যা বলে-Hello From the Children of Planet Earth.আরো আছে পৃথিবীর মোট ৬০টি ভাষায় রেকর্ড করা শুভেচ্ছা বানি এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষের শব্দ। দুইটা ভয়েজার প্রোবেই এই সিডি সংরক্ষিত আছে।
৩। পৃথিবী থেকে রেকর্ড করা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দ এবং পৃথিবীতে আসার নির্দেশনা! চিত্র:স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো একটি কপার সিডি যাতে পৃথিবীর যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষিত আছে।

ভ্রমণের টাইমলাইন:

  • ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৭: ভয়েজার ১ এর যাত্রা শুরু। এর ১৬ দিন আগে রওনা দেয় ভয়েজার ২। দুটো যানই এখন সৌরজগতের বাইরে।
  • জানুয়ারি ১৯৭৯: ভয়েজার ১ বৃহস্পতি প্রদক্ষিন করে। বৃহস্পতি গ্রহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি এটি পৃথিবীতে পাঠাতে সক্ষম হয়। বৃহস্পতি গ্রহে ঝড়ের ছবি এবং ভিডিও পাঠায়। যখন এটি বৃহস্পতির একদম কাছে থাকে তখন পৃথিবী থেকে এর দুরত্ব প্রায় দুই লাখ মাইল।
  • নভেম্বর ১৯৮০: দুটো প্রোবই বৃহস্পতির মহাকর্ষ অতিক্রম করে শনির দিকে এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়।এই সময়ে ভয়েজার ১ শনির কাছাকাছি অবস্থান করে। এসময় এটি শনির রিংয়ের গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারনা দেয় এবং এর রিমোট সেন্সরগুলো শনির পৃষ্ঠ এবং গ্যাস জায়ান্ট টাইটান(শনির একটি উপগ্রহ) সম্পর্কে গবেষণা করতে থাকে।
চিত্র:ভয়েজার ১ এর তোলা শনি গ্রহের ছবি।
  • ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ এ ভয়েজার এক পাইওনিয়ার ১০ কে অতিক্রম করে এবং সবচেয়ে দুরবর্তী মানুষ নির্মিত বস্তু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায় এবং তখনও সেটি প্রতি সেকেন্ডে সতেরো কিলোমিটার বেগে যাত্রা অব্যাহত রাখে।
চিত্র:ভয়েজার ২ এর তোলা নেপচুনের ছবি।
  • ২০১২ এর শেষের দিকে ভয়েজারের চারপাশের আবহাওয়াতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। ২০১৩ এর মার্চে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন যে এটি আমাদের সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে।
চিত্র:ভয়েজার এবং সৌরজগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য প্রোব।
  • সেপ্টেম্বর ২০১২ তে নাসা নিশ্চিত করে যে এটি ইন্টারস্টেলার মিডিয়ামে প্রবেশ করেছে। ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম হলো দুইটি নক্ষত্রের মধ্যেকার পদার্থ এবং ফাঁকা জায়গা।

ভবিষ্যত: আসলে ভয়েজারের ভবিষ্যত সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না। সৌরজগত পাড়ি দেয়ার পর এটি তার নিজ ইচ্ছামতো যেকোনো দিকেই যেতে পারে। এর ইঞ্জিনগুলো এখনও চালু আছে। তবে সবগুলো ক্যামেরা বন্ধ করতে হয়েছে। এটি হয়তো আরো দুই তিন বছর নাসার কাছে তথ্য প্রেরন করতে পারবে। ২০২৫ সাথে এর জ্বালানি সম্পুর্ন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এর ভ্রমণ অব্যাহত থাকবে। যেহেতু মহাকাশে কোনো বাঁধার সম্মুখীন হবে না।

তাছাড়া কোনো ধরনের জোতিস্ক বা মহাজাগতিক কনার সাথে এর সংঘর্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই এটি নির্দ্বিধায় এগি যেতে থাকবে অনন্তকাল পর্যন্ত। এটি এখন যেই গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই গতিতে আমাদের নিকটবর্তী সোলার সিস্টেম প্রক্সিমা সেন্চুরাইতে পৌছতেও এর সময় লাগবে প্রায় ৭৪৪০০ বছর!!!

ভয়েজার ১ সম্পর্কিত আরো কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্নগুলো নাসার সায়েন্টিস্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারদের করা হয়েছিলো।

১। ভয়েজার কি এখনো পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে ছবি তুলে পাঠাতে সক্ষম?
না!কারন সেই ১৯৯০ সালেই এর ক্যামেরাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।

২। কেন সক্ষম নয়?
বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে আসা আধানযুক্ত কনাগুলো সনাক্ত করার জন্য পর্যাপ্ত পাওয়ার এবং মেমোরি রাখার জন্য এর ক্যামেরাগুলো ছবি তোলা বন্ধ করে দেয়।

৩। ভয়েজার ১ থেকে একটি সিগন্যাল পৃথিবীতে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে??
প্রায় ১৭ ঘন্টা!!যদিও রেডিও সিগন্যাল আলোর গতিতে ভ্রমণ করে।

৪। কবে নাগাদ ভয়েজারের পাওয়ার পুরোপুরি শেষ হবে?
২০২০ সাল পর্যন্ত এর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো চালিয়ে রাখা যাবে। ২০২৫ সাল নাগাদ এর সবগুলো যন্ত্র সম্পুর্ন বন্ধ হবে।

৫। যাত্রাপথে ভয়েজারের গতির কি কোনো পরিবর্তন হবে?
না! এটি বর্তমানে যেই গতিতে আছে চিরতরে এই গতিতেই এগিয়ে যেতে থাকবে।

৬। ভয়েজারের প্রসেসর এবং কম্পিউটারের সাথে বর্তমানের প্রযুক্তির সাথে তুলনাটা কেমন দাড়াবে?
ভয়েজারের প্রযুক্তি থেকে বর্তমানের প্রযুক্তি প্রায় দুই লাখ সত্তর হাজার গুন উন্নত।

ভয়েজার সম্পর্কে আরো কিছু অজানা তথ্য

১। এর ভিতরে যেই মেমোরি রাখা আছে তার সাইজ কত জানেন?মাত্র ৬১ মেগাবাইট!!
২। ভয়েজারের ক্যামেরাগুলো এতই সার্প যে এটি প্রায় আধা মাইল দুর থেকে একটা ম্যাগাজিনের শিরোনাম স্পষ্ট পড়তে পারবে!!
৩। ভয়েজার ১ প্রায় ৬৫০০০ আলাদা যন্ত্রের কম্বিনেশন!!!
৪। ভয়েজার ১ একদিনে প্রায় ১ মিলিয়ন মাইল পথ অতিক্রম করে।

সুত্র:-www.wikipedia.com
www.popsci.com
www.voyeger.jpl.nasa.gov
www.reddit.com
www.astronomyisawesome.com

সর্বশেষ প্রকাশিত