মাস্টার্সের ফাইনাল তখন দরোজায়। পড়ালেখা বলতে গেলে তেমন কিছুই করিনি। কোলকাতার ক’জন বন্ধু ব্রাইটনে একটা বাসা ভাড়া করে থাকে। তাদেরকে ধরলাম। বললাম ‘আমায় পড়াতে হবে’। বললো ‘জম্পেস খাওয়াতে হবে মাইরি’। রাজি হলাম, চলে গেলাম তাদের মেসে। গ্রুপস্টাডি করছি শ্রীজিৎ, দেবব্রত, বিমল আর আমি। সবাই সাসেক্স ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আসলে ‘গ্রুপস্টাডি’ শব্দটা বেমানান হবে। বলতে হবে তারা আমায় পড়াচ্ছে। পাশের রুম থেকে অর্নব তার ল্যাপটপে গান ছাড়লো। গান শুনে আমি আনন্দে দিশেহারা। ‘মায়া লাগাইসে, পিড়িতী শিখাইসে, দেওয়ানা বানাইসে’! ব্রাইটনের কনকনে শীতের রাতে আমি চিৎকার করে বললাম ‘এ যে আমার দেশের বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান’। ওরা সবাই একসাথে বললো ‘আব্দুল করিমের গানতো কোলকাতায় ভীষণ জনপ্রিয়’। গর্বে আমার বুকটা একদম দুই ইঞ্চি উঁচু হয়ে গেলো।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেয়া এই মানুষটা পুরো পৃথিবীর বাঙালীর বিস্ময়। জীবনে কোনোদিন তিনি স্কুলে যাননি। ছোটবেলা ছিলেন রাখাল। একটু বড় হলে প্রচন্ড অভাবে মাঠে কৃষকের কাজ করতেন। সেই ছোটবেলা থেকেই নিজের মনের ভাবগুলো গানের ভাষায় ছন্দে ছন্দে প্রকাশ করতেন। একতারা একটাই ছিলো তার সঙ্গী। এই গান গাইবার অপরাধে পুরো গ্রাম তাকে বয়কট করলো। অপমানে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। আবার একদিন ফিরে এলেন নিজের ভীটায়। বিয়ে করে সংসারী হলেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে আপন করে নিলোনা। অপরাধ ঐ একটাই- গান। তার স্ত্রী অকালে মারা গেলে গ্রামের কেউ জানাজা পড়তে দিলোনা, অন্য গ্রামে গিয়ে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হলো তার স্ত্রীকে। এতোটা অবহেলা, এতোটা ত্যাগ কি কাউকে সইতে হয়েছে গান গাওয়ার অপরাধে? আমি জানিনা।
কিন্তু এতোবড় প্রতিভা কতোকাল আর গোপন থাকতে পারে? তার নাম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। বয়স ষাট পার হয়ে গেছে তখন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার নিমন্ত্রন পেলেন আব্দুল করিম। তার গান শুনে মানুষ মুগ্ধ। বিশ্বাস হচ্ছিলোনা যেনো কারও। দেশের লোক ভালোবেসে নাম দিলো ‘বাউল সম্রাট’। তার লিখা যে গানগুলো বছরের পর বছর অনাদরে পরে ছিলো সেই গানগুলো গুলশান, বনানী হয়ে সারা দেশের অভিজাত শ্রেনী থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের দোকানেও বাজতে থাকলো। ‘কোন মেস্তরী নাউ বানাইলো’, ‘কেনো পিড়িতী বাড়াইলারে বন্ধু’, ‘গাড়ি চলেনা চলেনা’ কিংবা ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’- কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো? চিরকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা মানুষটা শেষ বয়সে হয়ে গেলেন দেশের সেরা সেলিব্রেটি। হাবিব ওয়াহিদ সহ অনেক মিউজিক ডাইরেক্টরদের করা শাহ আব্দুল করিমের গানের রিমিক্স দেশের মাঝে হয়ে গেলো বেস্ট সেলার। এ যেনো রাখাল ছেলের বিশ্বজয়।
রাষ্ট্র তাকে সম্মানীত করলো। গানের ভুবনে তার অবদানের জন্যে তিনি পেলেন ‘একুশে পদক’। বয়সের ভারে তখন তিনি একদম বিছানায়। সরকার তার চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিলো। কিন্ত শেষ রক্ষা হলোনা। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, আজকের এই দিনে ৯৩ বছর বয়সে সিলেটে মারা গেলেন তিনি। রেখে গেলেন কোটি মানুষের জন্যে ভালোলাগার সুর। যে গ্রামের মানুষ তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো সেই ‘উজান ধল’ গ্রাম আর তারই নামে পরিচিত। ‘কার্তিমানের মৃত্যু নেই’, বাউল আব্দুল করিম আমাদের মাঝে না থাকলেও তার কাজ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরদিন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: Rumel M S Pir