উপমহাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের কথা জানা যায়, আমাদের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। আজ সারা বিশ্ব বেতার টেলিগ্রাফের আবিষ্কারক হিসেবে গুলিয়েলমো মার্কোনালিকেই স্মরণ করে। কিন্তু বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র যে সেই সময় অনুরূপ গবেষণার জন্য বেতারের আবিষ্কারক হতে পারতেন, সেটা কি আপনি জানেন?
জগদীশ চন্দ্র বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করলেও পেটেন্টের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না। এমনকি রেডিও সিগনাল শনাক্ত করণে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার বিষয়ে জগদীশ চন্দ্রের করা গবেষণাপত্র তিনি উন্মুক্ত করে দেন যেন অন্যান্য বিজ্ঞানীগণ এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। না হলে আজ অনেকগুলো পেটেন্টেরই অধিকারী হতে পারতেন এই মহাত্মা। সহকর্মীদের অনেক অনুরোধের পর মাত্র একটি পেটেন্ট সই করেছিলেন তিনি। চলুন এই মহান বাঙালি বিজ্ঞানী সম্পর্কে আজ জানা যাক।
জন্মস্থানঃ ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর আমাদের বাংলাদেশে! হ্যা আপনি ঠিক পড়েছেন! আমাদেরই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এই মহান বিজ্ঞানী। পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন একজন ডেপুটি কালেক্টর, তখন ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন। সেখানেই জগদীশ চন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিসম্পন্ন ও স্নেহশীলা নারী। বসু পরিবারের পৈতৃক বাড়ি হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের (বিক্রমপুর) রাঢ়িখাল গ্রাম। এখনো সেই বাড়ি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি হিসেবেই সুপরিচিত।
শিক্ষাজীবনঃ পিতা ভগবান বসু ফরিদপুরে বদলি হলে জগদীশ চন্দ্র পিতার কর্মস্থল ফরিদপুরে একটি গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে, সেখান থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। পরবর্তীতে ১৮৭৫ সালে তৎকালীন প্রবেশিকা (যা বর্তমানে মাধ্যমিকের সমমান) পাশ করে ভর্তি হলেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং এরপর সুযোগ পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।
তারপর তিনি চলে যান বিলেতে, সেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি তা ছেড়ে দিয়ে কেমব্রিজে ক্রাইস্ট কলেজে প্রকৃতি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি ও ১৮৮৪ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
কর্মজীবনঃ দেশে ফিরেই তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কলেজে শুধু যে গবেষণার জন্য কোন রকম সুবিধা দেওয়া হত না তাই নয়! তিনি ইউরোপীয় অধ্যাপকদের অর্ধেক বেতনেরও কম অর্থ পেতেন। তারই প্রতিবাদে জগদীশ চন্দ্র বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন এবং তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। এই প্রতিবাদের ফলে জগদীশ চন্দ্রের বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়েছিল।
গবেষণাঃ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বিশ্ববাসীকে প্রথম বারের মতো জানিয়ে ছিলেন উদ্ভিদের মধ্যে আছে প্রাণশক্তি। এটি প্রমাণের জন্যে তিনি ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা উদ্ভিদ দেহের সামান্য সাড়াকে লক্ষ গুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শন করে।
কিছু দিন আগেও পুরো বিশ্ববাসী রেডিওর আবিষ্কারক হিসেবে ইতালির বিজ্ঞানী মার্কোনিকেই জানত। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স এর প্রসিডিংসে জগদীশ চন্দ্রকে রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কারণ, মার্কোনি তাঁর আবিষ্কারে অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন যার মধ্যে একটি হচ্ছে কোহেরার।
মজার ব্যপার হচ্ছে এই কোহেরার এর প্রকৃত আবিষ্কারক হচ্ছেন জগদীশ চন্দ্র, যা মার্কোনি বা তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কেউ স্বীকার করেনি। জগচদীশ চন্দ্রের তৈরি কোহেরারটি থেকে মার্কোনি সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। বসুর কোহেরারটি ছিল ‘ইউ’ আকৃতির আর মার্কোনিরটি ছিল সোজা।
এছাড়াও, জগদীশ চন্দ্রের গবেষণাগুলোর মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হেরৎস প্রত্যক্যভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান।
জগদীশ চন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন, এমনকি মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।
লেখালেখিঃ জগদীশ চন্দ্রের সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধুত্ব ছিলো গভীর। কবিগুরু সাহিত্যরসে প্রগাড় হলেও বিজ্ঞানের বিষয়ে তিনি নিতান্ত জ্ঞান শুন্য, অন্যদিকে জগদীশ চন্দ্র বিজ্ঞানে নিপুণ হলেও সাহিত্যজ্ঞানে ছিলেন তুচ্ছ। সেদিক থেকে তাঁদের বন্ধুত্বের ফলে একদিকে রবীন্দ্রনাথ জগদীশ চন্দ্রের কাছ থেকে বিজ্ঞানের ব্যাপারে জানতেন এবংজগদীশ চন্দ্র রবীন্দ্রনাথের থেকে সাহিত্য সম্পর্কে জানতেন।
জগদীশ চন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। আর সেই প্রভাবেই ১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ নামক একটি গল্প লিখে ফেলেন। পরে অবশ্য একে আরো বিসতৃত করে ‘অব্যক্ত’ নামক রচনাসমগ্রে ‘পলাতক তুফান’ নামে সংকলিত করা হয়। বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম সায়েন্স ফিকশন। অর্থাৎ বাংলা সায়েন্স ফিকশনও আমাদের স্যার জগদীশ চন্দ্রের হাত ধরে এসেছে।
সম্মাননাঃ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য সম্মাননায় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুলো তুলে ধরা হল।
- আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বরে, ৭৮ বছর বয়সে মারা যান। তারই স্মরণে চাঁদের একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়েছে ‘বোস ক্রাটার’ নামে।
- জন্ম শতবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৫৮ সালে পশ্চিম বাংলায় বৃত্তি ব্যবস্থা চালু করা হয়। একই বছর ভারত সরকার তাঁর স্মরণে তাঁর ছবি সম্বলিত ডাকটিকেট প্রচলন করে।
- জীবদ্দশায় তিনি ভূষিত হয়েছেন নানা উপাধিতে। যেমন, নাইট ব্যাচেলর উপাধি, রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন, ভিয়েনা একাডেমী অব সায়েন্সের সদস্য হয়েছেন।
- এছাড়াও, ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনকে তাঁর স্মরণে ‘আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন’ নামকরণ করা হয়।
লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না।