-

লিওনেল মেসি:পৃথিবীবাসী ভিনগ্রহী!

“পৃথিবীবাসী ভিনগ্রহী” উপমাটা শুনে অবাক হয়ে গেলেন?যখন মানুষটার নাম “লিওনেল মেসি” তখন তার নামের পাশে “ভিনগ্রহী”,”অতিমানব”,জাদুকর ইত্যাদি উপমা নির্দ্বিধায় লাগানো যায়। মাত্র ৩১ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে বলা হয় ফুটবলের জাদুকর।অনেকেই তাকে বলে থাকেন “ভিনগ্রহী ফুটবলার” কেননা পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে এতটা প্রতিভাবান হয়ে ওঠাটা প্রায় অসম্ভব।লিওনেল মেসি সেটাই।তাকে নিয়ে লিখতে গেলে আপনার শব্দভান্ডারে প্রশংসামুলক শব্দ প্রচুর থাকা চাই! কেননা হয়তো তার অর্জন এবং প্রশংসা লিখতে গিয়ে আপনার শব্দভান্ডার যথেষ্ট হবে না,টান পড়ে যাবে!!

মেসির জন্ম হয়েছিল আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে।কিংবদন্তি আর্জেন্টাইন বিপ্লবী “চে গুয়েভারা” ও একই শহরেই জন্মেছিলেন।রোজারিও শহরটি খুব ভাগ্যবান!মেসির জন্ম রোজারিওর ইটালিয়ানো হাসপাতালে ১৯৮৭ এর ২৪ জুন।বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি।আসল বাড়ি ইতালিতে হলেও তার কোনো এক পুর্বপুরুষ আর্জেন্টিনায় চলে এলে মেসিরাও চলে আসেন আর্জেন্টিনায়।

মেসির মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একটা অনন্য প্রতিভা ছিল।ফুটবলে তিনি তার সমসাময়িকদের তুলনায় ছিলেন অনেক বেশি প্রতিভাবান।মেসির প্রথম ক্লাবের কোচ ছিলেন স্বয়ং তার বাবা হোরাসিও মেসি!৮ বছর বয়সে যোগ দেন “নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ” ক্লাবে।তারা “মেসিন অব ৮৭” নামে পরিচিত হয়েছিল কারন মেসি যোগদানের পর টানা চার বছরে মাত্র একটি ম্যাচ হেরেছিল।১৯৯৫-২০০০ সাল পর্যন্ত মেসি এখানে খেলেন।বয়স যখন ১১ তখন ভাগ্যের কাছে বড় এক ধাক্কা খেতে হয় লিওনেল মেসির।গ্রোথ হরমোনে সমস্যা দেখা দেওয়ার কারনে ডাক্তাররা বলে দেন মেসি আর চার ফুটের বেশি আর লম্বা হবে না।কিন্তু মেসির বাবা হাল ছাড়ার পাত্র নন।নিজের ছেলের মধ্যে তিনি যেই প্রতিভা দেখেছিলেন তার বিকাশ তিনি মনেপ্রাণে করতেই চাইতেন।সিনিয়র মেসি সবার আগে ছুটে গেলেন স্থানীয় ক্লাব রিভার প্লেট এর কাছে।মেসির অসাধারণ দক্ষতা দেখে তারা মেসিকে নিতে আগ্রহ দেখায়।কিন্তু তার চিকিত্সার জন্য যেই বিশাল টাকার প্রয়োজন ছিল সেটা বহন করার সামর্থ্য তাদের ছিলনা।এবার মেসির সাহায্যে এগিয়ে আসে বার্সেলোনার তখনকার ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্সাস।মেসির প্রতিভায় বিমুগ্ধ হয়ে তিনি মেসিকে বার্সেলোনায় নিচে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তার চিকিত্সার ব্যায়ভার ও গ্রহন করেন।সেদিন রেক্সাস তাৎক্ষনিক ভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য পাচ্ছিলেন না দেখে একটি ন্যাপকিন পেপারেই চুক্তি স্বাক্ষর করেন! মেসির ভাগ্য খুলে যায়!সাথে সাথে বদলে যায় বার্সেলোনার ভাগ্য ও।

২০০৪ এর শেষের দিকে লা লীগাতে অভিষেক ঘটে মেসির।পরের বছর লা লীগাতে বার্সার হয়ে সবচেয়ে কনিষ্ঠতম বয়সে গোল করার রেকর্ড করেন।এই মৌসুমে লা লীগায় ১৭ ম্যাচে ছয় গোল করেন।২০০৫ এ স্পেন এর নাগরিকত্ব লাভের পর চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলার সুযোগ পান মেসি।২০০৬-২০০৭ মৌসুমের প্রতিটা খেলায় মেসি নিয়মিত গোল পান।কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই মৌসুমে এল ক্লাসিকোতে চির প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক! ম্যাচটি ৩-৩ গোলে ড্র হয়েছিলো।

মেসির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে গেটাফের বিপক্ষে এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা একটি গোল দেওয়ায় যেটি কিনা অনেকটাই আর্জেন্টিআইন লিজেন্ড ম্যারাডোনার ১৯৮৬ এ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেওয়া গোলটির মতো।এই গোলটি দিতে মেসি প্রায় ৬২ মিটার দৌড়ে এসেছিলেন এবং ট্যাকল করেছিলেন গোলকিপারসহ ছয়জন খেলোয়াড়কে।অনেকেই মেসিকে দ্বিতীয় ম্যারাডোনা ডাকতে শুরু করেন।২০০৮-২০০৯ মৌসুম বার্সেলোনার জন্য ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে।দল থেকে রোনালদিনহোর বিদায়ের পর মেসি পেয়ে যান ১০ নম্বর জার্সি।এই মৌসুমে সর্বপ্রথম কোন স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব হিসেবে ট্রেবল(উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ,লা লিগা,কোপা দেল রে) জিতে বার্সেলোনা।নায়ক ছিলেন মেসি।এই মৌসুমে মেসি সব মিলিয়ে ৩৮ টি গোল করেন এবং সাহায্য করেন ১৮ টি গোলে।মেসির এই অভুতপুর্ব সাফল্য এবং প্রতিভা দেখে বার্সেলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিয়োলা বলেন “মেসিই সম্ভবত আমার দেখা সেরা প্লেয়ার” চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে এই মৌসুমে ৯ গোল করে রেকর্ড করেন।ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় প্রথমবারের মতো স্থান পান।অর্জন করেন দ্বিতীয় অবস্থান।

২০০৯ এ মেসি বার্সেলোনার সাথে ২৫০ মিলিয়ন ইউরোর চূক্তি করেন।চুক্তির মেয়াদ ২০১৬ পর্যন্ত।২০০৯ এর ১ ডিসেম্বর মেসি ব্যালন ডি অর অর্জন করেন।সে বছর মেসির পয়েন্ট ছিল ৪৭৩।অন্যদিকে মাত্র ২৩৩ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো!একই সালে আবুধাবীতে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে বার্সেলোনার শিরোপা জয়ের নায়ক হন মেসি।ফাইনালের দুইদিন পরই তিনি প্রথম আর্জেন্টাইন হিসেবে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।

২০১০ কে বলা হয় মেসির হ্যাট্রিকের বছর। মৌসুমের শুরুতেই টানা তিনটি হ্যাট্রিক!চ্যাম্পিয়নস লিগে আর্সেনালের বিপক্ষে এক ম্যাচে করে ফেলেন চার গোল!! এরপর নিয়মিত গোল আসতে থাকে মেসির পা থেকে।সেই বছর কোপা দেল রের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে।মেসে গোল পেলেও বার্সেলোনা হেরে যায় ম্যাচটিতে।প্রতিপক্ষের তারকা খেলোয়াড় রোনালদোর সাথে সর্বোচ্চ সাত গোলে ভাগ বসান লিওনেল মেসি।পরের মৌসুমে বায়ার্ন লেভার্কুনেসের বিপক্ষে এক ম্যাচে পাচ গোল দিয়ে রেকর্ড করেন মেসি।২০১১-২০১২ মৌসুমে বার্সেলোনার ঝুলিতে শুধুমাত্র কোপা দেল রে! কিন্তু মেসি আপন মহিমায় উজ্জ্বল।লা লীগার এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৫০টি গোল এবং চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৪ গোলের রেকর্ড করেন।

লিওনেল মেসি তার ক্যারিয়ারের রেকর্ডগুলো উল্লেখ করতে প্রচুর সময় লেগে যাবে।তাই সেগুলো উল্লেখ করে লেখাটা বড় করতে চাইনা।তবে যেসব রেকর্ড উল্লেখ না করলেই নয়-
⚬সর্বোচ্চবার(৫ বার) ব্যালন ডি অর জেতার রেকর্ড।
⚬টানা একুশটি ম্যাচে গোল করার রেকর্ড।
⚬এক বছরে সর্বোচ্চ(৯১) টি গোলের রেকর্ড।গিনেস বুকে নাম লেখানো।
⚬ইউরোপীয় লিগে সর্বোচ্চ গোল্ডেন শ্যু।
⚬ইউরোপীয় লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ(৭৩) গোল এবং এক বছরে সর্বোচ্চ(৭৯) গোল।
⚬উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ হ্যাট্রিক।এক মৌসুমে চারটি।
⚬ইউরোপিয়ান কাপে টানা চারবার সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার।
⚬জাতীয় দলের হয়ে এক বছরে সর্বোচ্চ গোল।
⚬সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেন।
⚬আর্জেন্টিনা দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
⚬লা লিগায় মেসির যত রেকর্ড:এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোল(৩৫৯),সর্বোচ্চ অ্যাওয়ে গোলদাতা(১০৭),এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল(৫০),সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ২শ গোলের রেকর্ড,এল ক্ল্যাসিকোতে সর্বোচ্চ গোল(২০), এল ক্লাসিকোতে সর্বোচ্চ হ্যাট্রিক(২) টি।
⚬বার্সেলোনা ক্লাবে মেসির যত রেকর্ড:অফিশিয়াল প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোলদাতা,উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা(১০০),লা লিগায় সর্বোচ্চ হ্যাট্রিক(২৯),সব ধরনের প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ হ্যাট্রিক(৪০)

২০১০ সালে ফ্রান্স ভিত্তিক ম্যাগাজিন “ফ্রান্স ফুটবল” মেসিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ফুটবলারদের কাতারে মেসিকে প্রথম স্থানে রাখেন।তার মোট সম্পত্তি প্রায় ১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।বার্সেলোনাতে মেসি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।মেসির স্ত্রী অ্যান্তোনেল্লা রোকুজ্জো যিনি মেসির আত্মীয় এবং ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন।তাদের বর্তমানে তিনজন সন্তান-সন্তনি আছে।

লিওনেল মেসি যেমন ধনী তেমনই দানশীল।ফোর্বসের তালিকায় মেসি বিশ্বের সেরা ৫০ জন দানশীল ব্যাক্তিদের একজন।লিওনেল মেসির দানশীলতার কিছু নিদর্শন:
⚬মেসি তার ইনকামের ৮০% ইউনিসেফে দান করেন।
⚬ইউনেস্কোর আয়ের ২৭% আসে মেসির দান থেকে।
⚬লিওনেল মেসি প্রতি বছর ৪০ মিলিয়ন শিশুদের স্কুলের ব্যায়ভার পালন করেন।
⚬মেসি বার্সেলোনা থেকে পাওয়া বেতনের একটা বড় অংশই দান করেন বার্সেলোনারই যুব উন্নয়ন প্রকল্প “লা মাসিয়াতে”
⚬মেসির নিজস্ব চ্যারিটেবল ট্রাস্ট “মেসি ফাউন্ডেশন” বছরে ১০ মিলিয়ন ইউরো শিশুদের উন্নয়নে ব্যায় করে।
⚬বিশ্বকাপ ফাইনালে রানার্সআপে পাওয়া সকল টাকা আর্জেন্টিনার একটি হাসপাতালে দান করে দেন।
⚬যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার শিশুদের পাশে দাড়িয়ে মেসি ২০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে দেন এবং ১৬০০ শিশুর লেখাপড়ার খরচ বহন করেন।

সর্বশেষ প্রকাশিত