কম টাকায় কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে ডিলারশিপ ব্যবসা শুরু করা বর্তমান সময়ের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসায় আইডিয়া।
ডিলারশিপ ব্যবসাটি সাধারন ব্যবসাগুলো থেকে মানুষের কাছে বেশি পছন্দের। কারন এই ব্যবসাতে দিনব্যাপী সময় দেওয়া এবং একই স্থানে একঘেয়েমি নিয়ে ব্যবসা করার প্রয়োজন হয়না। তাছাড়া একটি নিজস্ব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে যেই পরিমান বিনিয়োগ লাগে, তার থেকে অনেক কম টাকা নিয়েই ডিলারশিপ ব্যবসা করা যায়।
ভালো মার্কেটিং ধারনা থাকলে, খুব দ্রুতই এই ব্যবসায় সফল হওয়া সম্ভব। তাই যারা ডিলারশিপ ব্যবসায় আগ্রহী, তাদের জন্য এই আর্টিকেলে ডিলারশিপ ব্যবসা কি এবং বাছাই করা ৭ টি ডিলারশিপ ব্যবসা আইডিয়া তুলে ধরা হলো।
ডিলারশিপ ব্যবসা কি?
ডিলারশিপ ব্যবসা বলতে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোন একটি কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে পণ্য ডিস্ট্রিবিউট বা বিতরণ করার ব্যবসাকে বুঝায়। এক্ষেত্রে ডিলারগণ মূলত উৎপাদনকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
প্রাথমিকভাবে ডিলারগণ একটি কোম্পানিতে ব্যবসার জন্য নিবন্ধন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ Security Money হিসেবে জমা রাখে। তারপর সেই কোম্পানির পণ্য ডিলারের গোডাউনে/ প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। পরবর্তীতে ডিলারগণ কোম্পানির সেলসম্যান এর মাধ্যমে বিভিন্ন খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ডার নিয়ে পণ্য বিতরণ করে।
এই ব্যবসাতে ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে, কারণ পন্য নষ্ট হলে কোম্পানিতে ফেরত দেওয়া যায়। অন্যদিকে, অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় লাভের পরিমাণও কিছুটা বেশি। কিন্তু এই ব্যবসাটি শুরু করার জন্য আপনার স্থানীয় বাজার চাহিদা এবং মার্কেটিং সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এভাবে সাথে যত বেশি পণ্য বিতরণ/ ডিস্ট্রিবিউট করতে পারবেন, আপনার তত বেশি ইনকাম হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানিগুলো ডিলারদের প্রতি ১ লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রিতে ৫-১৩% কমিশন দিয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতি মাসে কোম্পানি থেকে দেওয়া টার্গেট ফিলাপ করতে পারলে বাড়তি ইনসেপটিভ পাওয়া যায়।
৭টি ডিলারশিপ ব্যবসার আইডিয়া
(১) গাড়ির পার্টসের ডিলারশিপ
গাড়ির যন্ত্রাংশের ডিলারশিপ ব্যবসা বাংলাদেশের বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য একটি আকর্ষণীয় উদ্যোগ। গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই এই ধরনের ব্যবসার চাহিদা অনেক। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে উপযুক্ত জায়গা বাছাই করতে পারলেও লাভজনক হবে।
গাড়ির পার্টসের ডিলারশিপ নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি টায়ার, ব্রেক, ব্যাটারি, ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের মতো বিভিন্ন পণ্য বাছাই করতে পারেন। ব্যক্তি গ্রাহক ছাড়াও, মেকানিক দোকানগুলো এই যন্ত্রাংশের প্রধান ক্রেতা। যেহেতু যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাই এ ধরণের যন্ত্রাংশের চাহিদাও বাড়ছে।
ব্যবসার শুরুতে আপনার যন্ত্রাংশের প্রাথমিক মজুদ, সুপরিচিত/ বড় কোন কোম্পানির ডিলার নেওয়া, এবং একটি উপযুক্ত স্থানে দোকানের প্রয়োজন। পরবর্তীতে, গ্রাহক ধরে রাখতে ভালো মানের পণ্য ও দ্রুত সেবা প্রদান করার চেষ্টা করবেন। এই ডিলারশিপ ব্যবসা ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারলে মাসিক ৩০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম করতে পারবেন।
(২) কসমেটিকস আইটেমের ডিলারশিপ
বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রান্তেই কসমেটিকস আইটেমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ দিয়েছে। তবুও অনেক কোম্পানির পণ্য বিভিন্ন এলাকায় সহজভাবে পৌছাতে পারছে না ডিলারের অভাবে।
আপনি বিভিন্ন কসমেটিকস কোম্পানির ওয়েবসাইট কিংবা আঞ্চলিক অফিসে যোগাযোগ করে ডিলারশিপ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার আশেপাশের এলাকার প্রসাধনী সামগ্রীর দোকানগুলোকে টার্গেট করে মার্কেটিং করতে হবে। কসমেটিক্স ডিলারশিপে ত্বক এবং চুলের যত্নের পণ্য, মেকআপ সামগ্রী, সুগন্ধি ইত্যাদি সামগ্রী রাখতে পারেন।
শহর এবং গ্রাম উভয় স্থানেই এই ধরনের ডিলারশিপ লাভজনক হতে পারে। এমন পণ্যের ডিলারশিপে তূলনামূলক বেশি কমিশন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয় পণ্য গুলো নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে, তারপর মার্কেটে পরিচিতি অর্জন করতে পারলে বিভিন্ন পণ্য যুক্ত করতে পারেন। ব্যবসার শুরুতে আপনার প্রয়োজন হবেঃ
- পণ্য স্টক করে রাখার জন্য জায়গা।
- বিভিন্ন কসমেটিকস কোম্পানিতে ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে নিবন্ধন।
- প্রাথমিক সিকিউরিটি বা বিনিয়োগ হিসেবে ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা।
- স্থানীয় বাজার এবং মার্কেটিং সম্পর্কে ধারনা।
- পুজি বেশি থাকলে, পাশাপাশি নিজের একটি দোকানও ভাড়া নিতে পারেন।
ভালো মার্কেটিং ধারনা থাকলে, প্রতিমাসে ৩০-৫০ হাজার টাকার পর্যন্ত ইনকাম করা সম্ভব। আপনি চাইলে অনলাইন প্লাটফর্মেও এই ব্যবসাটি পরিচালনা করতে পারেন।
(৩) নির্মাণ সামগ্রীর ডিলারশিপ (ইট, সিমেন্ট, রড)
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন অট্টালিকা নির্মানের প্রতিযোগিতা চলছে। আর নির্মান কাজের জন্য নির্মান সামগ্রী, যেমন- ইট, সিমেন্ট, রড, বালু ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা থাকে বছরব্যাপী। আপনার কাছে মোটামুটি ৮-১০ লক্ষ টাকা পুজি থাকলে এই লাভজনক ডিলারশিপ ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
নির্মাণ সামগ্রীর ডিলারশিপরা মূলত দেশের বড় বড় কোম্পানি গুলো থেকে সিমেন্ট, রড ইত্যাদির ডিলারশিপ নিয়ে থাকে। পাশাপাশি নিজে এলাকার আশেপাশের ইটের ভাটা ও বালু ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত থেকে কমিশনে ব্যবসা করতে পারে। শহর ও গ্রাম উভয় স্থানেই এই ব্যবসা লাভজনক।
এই ব্যবসা শুরুর জন্য আপনার প্রয়োজন হবেঃ
- পণ্য রাখার জন্য একটি বড় জায়গা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।
- মালামাল পরিবহনের জন্য একটি গাড়ি (শুরুতে ভাড়ায় নিতে পারেন)।
- জনপ্রিয় কোম্পানি গুলোর পণ্যের ডিলারশিপ নেওয়া।
- শুরুতে নিজ এলাকায় প্রচার প্রচারনা করা।
এই ধরনের ডিলারশিপ ব্যবসায় লাভের হার নির্ভর করে বিক্রির উপর এবং বিভিন্ন মাসে কম-বেশি হয়ে থাকে।
(৪) চামড়ার পণ্যের ডিলারশিপ
বাংলাদেশে চামড়ার পণ্যের বাজার অনেকটাই বড় পরিসরের। তবে এই ব্যবসার ডিলারশিপ সম্পর্কে মানুষের ধারনা তূলনামূলক কম। বিভিন্ন চামড়াজাত পণ্য, যেমন- ব্যাগ, বেল্ট, জুতো, মানিব্যাগ ইত্যাদি পণ্য নিয়ে আপনি এই ডিলারশিপ ব্যব্যসাটি শুরু করতে পারেন।
এই ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দিক হলো উচ্চমানের চামড়ার পণ্য বাছাই করা। সঠিক পণ্য বাছাই করতে পারলে বাজারদর থেকেও বেশি দামে বিক্রি করা যায় অনায়াসেই। শুরুতে আপনার আশেপাশের মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে মার্কেটিং করে পণ্যের চাহিদা সম্পর্কে জেনে নিবেন। তারপর টেকসই পণ্য সরবরাহ করে খুচরা ব্যবসায়ীদের আকর্ষন করতে হবে।
আপনার মূলধন বেশি থাকলে নিজের একটি বানিজ্যিক দোকান নিয়েও ব্যান্ডিং করতে পারবেন। এই ধরনের ব্যবসায় প্রাথমিক পুজি ১ থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, তা পণ্যের উপর নির্ভর করবে। মার্কেটিং ধারনা ভালো থাকলে এবং পরিশ্রমি হলে শুধুমাত্র ডিস্ট্রিবিউট করেই মাসে ৩০-৫০ হাজার টাকার উপার্জন সম্ভব। আর নিজের একটি দোকান থাকলে এই ইনকাম দ্বিগুনও হতে পারে।
(৫) কাগজ ও স্টেশনারি পণ্যের ডিলারশিপ
কাগজ, খাতা, কলম, এবং অন্যান্য স্টেশনারি পণ্যের চাহিদা স্কুল, কলেজ, অফিস সব জায়গাতেই রয়েছে। এই পণ্যের চাহিদা সারাবছরই থাকে, তাই এটি একটি স্থিতিশীল ব্যবসা। এই ধরনের ব্যবসার ডিলারশিপ নিতে তূলনামূলক কম পুজি লাগে।
আপনার নিজের এলাকায় কয়েকটি স্টেশনারি কোম্পানির ডিলার নিয়ে একসাথে ব্যবসা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনার নিজের একটি লাইব্রেরি থাকলে ব্যবসাটি বেশি লাভজনক হবে।
ব্যবসা শুরুর জন্য প্রাথমিকভাবেঃ
- কোম্পানির ডিলারশিপ নিতে হবে।
- স্থানীয় বাজার চাহিদা জেনে নিতে হবে।
- স্কুল-কলেজের পাশে দোকান নিতে পারেন।
- প্রাথমিকভাবে সরবরাহকারী এবং ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করতে হবে।
- একাধিক পণ্য নিয়ে ব্যবসায় বৈচিত্র রাখতে হবে।
উপযুক্ত স্থান ও মার্কেটিং স্ট্রাটেজি সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকলে,.৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে মাসিক ২০-৫০ হাজার টাকা উপার্জন সম্ভব।
(৬) কৃষিপণ্য ও কৃষি যন্ত্রপাতির ডিলারশিপ
গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষিপণ্য ও যন্ত্রপাতির ডিলারশিপ ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক। এই ধরনের ব্যবসার প্রতিযোগিতা তূলনামূলকভাবে কম। বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ও দেশি বীজ, সার, কীটনাশক এবং ছোট কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
প্রাথমিকভাবে ব্যবসাটি শুরু করতে আপনার প্রয়োজন হবেঃ
- একটি দোকান বা মজুদঘর ভাড়া।
- বেশ কয়েকটি ভালো কোম্পানির ডিলারশিপ (একসাথে নিতে পারবেন)।
- শুরুতে দোকান ছাড়া শুধু পণ্যের জন্য ১-১.৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ।
- কৃষি সম্পর্কে ব্যক্তিগত ধারনা।
এই ব্যবসা থেকে মাসে ৩০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা আয় করা সম্ভব। স্থানীয় এলাকায় একবার দোকানের প্রচারনা হলে, দীর্ঘদিন মার্কেটিং ছাড়াই ব্যবসা করতে পারবেন।
(৭) গুঁড়া মসলার ডিলারশিপ
উচ্চ গুণগতমান সম্পন্ন গুঁড়া মশলার চাহিদা বর্তমানে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে অর্গানিকভাবে উৎপাদিত গুঁড়া মশলা দিন দিন আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের মসলা, যেমন: হলুদ, মরিচ, জিরা, ধনিয়া, পাঁচফোড়ন, বিরিয়ানির মসলা, রোস্টের মসলা, বার-বি-কিউ মসলা, ম্যাজিক মসলা ইত্যাদি মসলা জাতীয় দ্রব্য নিয়েও সফলভাবে ব্যবসা করা যায়।
এ ধরনের ব্যবসাতে লাভের হার অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় কিছুটা বেশি থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড কোম্পানি, যেমন- রাধুনী, ফ্রেশ, প্রাণ, বিডি ফুড ইত্যাদি কোম্পানির ডিলার নিয়ে আপনি ব্যবসা করতে পারবেন। এর জন্য সেসকল কোম্পানির ওয়েবসাইটে বা শাখা অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
প্রাথমিকভাবে ১-২ লক্ষ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। তারপর স্থানীয় বাজার ও মার্কেটিং সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে প্রতি মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা ইনকাম করা সম্ভব। অন্যদিকে, আপনি যদি অর্গানিকভাবে মসলা উৎপাদন করে অনলাইনে ও অফলাইনে বিক্রি করতে চান তাহলেও অল্প টাকায় বাড়তি ইনকাম করা সম্ভব।
শেষকথা
নিচের ডিলারশিপ ব্যবসা গুলো থেকে কোনটি শুরু করতে চাইলে, সেই ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিবেন।