থাইল্যান্ডের থ্যাম লুয়াং গুহায় দুই সপ্তাহ ধরে আটকা থাকার পর উদ্ধার কিশোর ফুটবল দলের সদস্যরা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের কাছে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। বুধবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে উইল্ড বোর ফুটবল দলের ১২ সদস্য ও কোচ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন।
ফুটবল দলের ১৪ বছর বয়সী সদস্য আদুল স্যাম-অন তাদের খুঁজে পাওয়ার মুহূর্তের কথা স্মরণ করে বলেন, এটা ছিল ‘অলৌকিক মুহূর্ত’। পথ বানাতে আমরা পাথর ঘষছিলাম। এর মধ্যে একজনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম! দেখতে বিদেশি মনে হওয়ায় তাদের আমি হ্যালো বললাম। ব্রিটিশ ডুবুরিরা যখন তাদের গুহার অন্ধকার উঁচু এক ঢিবিতে খুঁজে পান তখন প্রথমে এই ঘটনাকে বিশ্বাস করতে পারেননি কিশোররা।
কিশোররা বলেন, গুহায় আটক থাকাকালীন সময় পার করার জন্য তারা হপ-স্কচ খেলার চেষ্টা করেন। ১০ দিনের আটকাবস্থার সময় গুহা থেকে বের হয়ে আসার জন্য তারা পথ খোঁজার চেষ্টাও করেন।
প্রথম নয়টি দিন অন্ধকার গুহায় বেঁচে থাকার বিষয়ে টি নামের কিশোর বলল, ‘আমরা শুধু বৃষ্টির পানি পান করতাম। পানিটা স্বচ্ছ ছিল। আর কোনো খাবার ছিল না।’
সবচেয়ে কম বয়সী সদস্য টিটান বলে, ‘আমার কোনো শক্তি ছিল না। আমি খাবারের কথা ভাবিনি। কারণ, খাবারের কথা ভাবলে আমার আরও বেশি ক্ষুধা লাগছিল।’
আটকে পড়া ১৩ জনের মধ্যে একমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন সহকারী কোচ এক্কাপল চানতাওয়াং (২৫)। তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ আমাদের পাবে—এই আশায় বসে না থেকে আমরা বের হওয়ার পথ খনন করার চেষ্টা করেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘সব কিশোর খুব কষ্টে ছিল। তারা ভাবছিল, তাদের কারণেই তাদের মরতে হচ্ছে। তাদের কারণে পরিবার বিপদে পড়েছে।’
কোচ এবং দলের সদস্যদের পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন স্যাম। ব্রিটিশ ডুবুরিরা যখন তাদের কাছে পৌঁছায় সেই সময়ের কথা স্মরণ করে স্যাম বলেন, প্রথমে আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, এটি সত্যি। আমরা ভয়ে ছিলাম; তারা দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। এজন্য অামি তাদের ‘হ্যালো’ বলেছিলাম।
স্যাম বলেন, আমি প্রথমে তাদের কাছে থেকে হ্যালো শব্দটি শুনতে পেয়েছিলাম; কিন্তু তাদের দেখতে পাইনি। আমরা তাদের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম; কারণ তারা পানিতে সাঁতার কেটে আসছিল। তারা কিছু একটা বলছিল।
‘আমি মনে করেছিলাম তারা থাই কর্মকর্তা কিন্তু যখন তারা পানি থেকে উঠে আসে তখন বুঝতে পারি যে, তারা ইংরেজ। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলবো। সে জন্য হ্যালো বলেছিলাম।’
‘এটা ছিল অলৌকিক, আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক করছিল, কখন আমরা বাইরে যেতে পারবো। এরমাঝে তিনি জানতে চান, আমরা কেমন আছি। আমি বলেছিলাম, আমরা ঠিক আছি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি কী তোমাকে সাহায্য করতে পারি? তিনি বলেছিলেন, না, ওপরের দিকে যাও।’
‘তারা জানতে চেয়েছিল, তোমরা কতজন? আমি বলেছিলাম, ১৩ জন। তারা বলেছিলেন, দুর্দান্ত।’
গণমাধ্যমে গুহায় আটকা থাই কিশোররা সাঁতার জানেন বলে জানানো হলেও তাদের কোটচ একাপ্পল চ্যান্তাওং বলেছেন, ছেলেরা সাঁতার কাটতে জানে। তারা আটকা পরার আগে কখনোই গুহায় যায়নি। কিন্তু অতীতে অনলাইনে গুহায় যাওয়ার ছবি পোস্ট করেছিলেন এই কোচ।
তিনি বলেন, পানি বাড়ায় প্রথমে তারা বুঝতে পারেন যে আটকা পড়তে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে কেউ ভয় পায়নি। কারণ তাদের ধারণা ছিল, দিনের শেষে পানি কমে যাবে এবং উদ্ধারকারীরা চলে আসবেন। কিন্তু তিনি যখন বুঝতে পারলেন পানি কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তখন যে জায়গায় আটকা ছিল তার পেছনের দিকে পথ খোঁজার জন্য কিশোরদের নির্দেশ দেন তিনি। তার ধারণা ছিল, পথ খুঁজে পেলে দঁড়ি বেয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়া যাবে।
শরীরে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গুহায় আটকাবস্থার সময় উইল্ড বোর ফুটবল দলের এই কোচ কিশোরদের ধ্যানের অনুশীলন করিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান।
গত ২৩ জুন থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় চিয়াং রাই প্রদেশের থাম লুয়াং গুহায় বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয় ১২ খুদে ফুটবলার ও তাদের কোচ। ১২ কিশোরের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। তাদের সহকারী কোচ এক্কাপোল জানথাওংয়ের বয়স ২৫ বছর। তারা ওয়াইল্ড বিয়ার্স বা মু পা নামের একটি ফুটবল দলের সদস্য। নয় দিন গুহার ভেতরে আটকে থাকার পর ২ জুলাই ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন তাদের সন্ধান পান। অবস্থান জানার পর ১২ কিশোর ও তাদের কোচের জন্য গুহার ভেতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করার পাশাপাশি পাঠানো হয় খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। তবে ৫ জুলাই রাতে কিশোরদের কাছে অক্সিজেনের সরঞ্জাম পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে প্রাণ হারান থাই নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি সামান কুনান।
৭ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার এক চিকিৎসক গুহায় ঢুকে কোচ ও কিশোরদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে উদ্ধার অভিযান শুরুর সবুজসংকেত দেন। তাদের অবস্থানস্থলে যাওয়ার জন্য ওই পাহাড়ে শতাধিক গর্ত করা হয়। তবে সেখানে কিশোরদের না পেয়ে আগের পরিকল্পনামতো ডুবসাঁতার দিয়ে তাদের উদ্ধারে চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয় ৮ জুলাই। প্রথম দিন চারজন ও দ্বিতীয় দিন ৯ জুলাই চারজন আর তৃতীয় দিন ১০ জুলাই চার কিশোরসহ তাদের কোচকে উদ্ধার করা হয়।