ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে জানে না এরকম মানুষের সংখ্যা বর্তমানে খুব কম। বর্তমান সময়ে মহাকাশ গবেষণার অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো ব্ল্যাকহোল। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। রোজই পত্রিকার পাতা উল্টালে বা ইন্টারনেটে এ সম্পর্কে খবর পড়ে থাকি। বেশ কিছু হলিউড ফিল্মেও ব্ল্যাকহোল দেখানো হয়েছে। সত্যি বলতে,ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমরা আজ পর্যন্ত খুব কমই জানতে পেরেছি। তো শুরু করার আগে এর সংঙাটা একবার জেনে নেই- ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর হলো বিশাল পরিমাণ ভরবিশিষ্ঠ কোনো বস্তু যার মহাকর্ষ বল অনেক বেশি হওয়ায় কোনো বস্তুই এর মহাকর্ষ বলয় ভেদ করে বের হতে পারেনা। এমনকি আলো পর্যন্তও এর ভেতর থেকে বের হতে পারে না।আমরা জানি যে কোনো বস্তুকে অন্য আরেকটি বস্তুর মহাকর্ষ বলয় ভেদ করতে হলে তার নির্দিষ্ট পরিমাণ মুক্তিবেগ দরকার। অর্থাত্ এই নির্দিষ্ট পরিমাণ বেগে বস্তুটি উপরের দিকে যাত্রা শুরু করলে সেটি অন্য বস্তুর মহাকর্ষ অতিক্রম করতে পারবে। যেমন পৃথিবীর মুক্তিবেগ হলো সেকেন্ড প্রায় ১১ কিলোমিটারের মতো। কোনো বস্তু যদি এই পরিমাণ বা এর চেয়ে বেশি বেগে পৃথিবীর বিপরীতে যাত্রা করে তবে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবেনা। এই কৌশলটা কাজে লাগিয়েই কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে স্থাপন করা হয়। আলোর বেগ হলো সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার!! অর্থাত্ অতি সহজেই এটি পৃথিবীর মহাকর্ষ অতিক্রম করতে পারবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে কোনো বস্তুর মুক্তিবেগ এর চাইতেও বেশি?? নিশ্চয়ই আলোও এর থেকে বের হতে পারবে না!!! এই বস্তুটাই কৃষ্ণগহ্বর। যার থেকে আলো পর্যন্তও বের হয় না। এজন্যই মুলত ব্ল্যাকহোলের ভেতরটা সম্পুর্ন কালো দেখা যায়। এজন্যই এর নাম দেয়া হয়েছে “কালো গহ্বর”।
ইংরেজিতে BlackHole. যেহেতু বিশাল পরিমাণ মহাকর্ষের কারনে এর সৃষ্টি হয় তাই এর সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আগে “মহাকর্ষ” জিনিসটা আসলে কি? তা আগে জানতে হবে।যদিও আমরা সবাই জানি যে মহাকর্ষ এক ধরনের বল যা প্রত্যেকটা বস্তুর মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু এটা হলো নিউটনের ধারনা।সত্য হলো এই ধারনাটা আসলে আংশিক সঠিক,অর্থাত্ এই ধারনার মধ্যে সামান্য ভুল রয়েছে। এর ভুলটা ধরার জন্য আমাদের নিউটনকে ছেড়ে আইনস্টাইনের ধারনায় যেতে হবে। ভুলটা হলো মহাকর্ষ আসলে কোনো বল না। এটি হলো আমাদের চারপাশের স্থান কালের সংকোচনের ফলে সৃষ্ট একটি গর্তের মতো। স্থান কালের সংকোচনের কারনে বস্তুর চারপাশে ঢালু জায়গা সৃষ্টি হয় যার কারনে আশেপাশের বস্তুসমুহ ওই বস্তুটার দিকে ধাবিত হয়।নিচের চিত্র দেখলে ব্যাপারটা অনেকটা পরিস্কার হয়ে যাবে-
এই ধারনার প্রবর্তক হলেন মহান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি আমাদের চারপাশের স্থানকে একটি চাদরের সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন ভরসম্পন্ন বস্তু এই স্থান-কালের মধ্যে বিকৃতি ঘটায় এবং এটাকে খানিকটা নিচের দিকে সংকুচিত করে ফেলে। যেই বস্তুর ভর বেশি সেটা বেশি সংকোচন ঘটায় এবং চারপাশের বস্তুসমুহ এর দিকে বেশি আকর্ষণ অনুভব করে যেহেতু সংকোচন যত বেশি ঢালুর পরিমাণও তত বেশি। এই স্থান-কালকে(Space Time) আইনস্টাইন বস্তুর চতুর্থ মাত্রা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। যেখানে স্থান এবং সময় জড়িয়ে এক হয়ে গেছে। বস্তুর অন্য তিনটি মাত্রা হলো দৈর্ঘ্য,প্রস্থ এবং উচ্চতা।সময় হলো বস্তুর পঞ্চম মাত্রা। সময় আসলে পরম কিছু নয়,এটিও আপেক্ষিক এরও বিকৃতি ঘটানো সম্ভব। এগুলোই ছিলো মুলত আইনস্টাইন এর আপেক্ষিক তত্তের মুল বিষয়-বস্তু। অর্থাত্ আমরা যদি কোনদিন পঞ্চম মাত্রায় যেতে পারি তবে আমরাও দৈর্ঘ্য,প্রস্থ উচ্চতার মতো সময়কেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।ইচ্ছে করলেই ভবিষ্যতে চলে যেতে পারবো বা অতীতেও ফিরে যেতে পারবো। তো এতক্ষণে আমরা মহাকর্ষ এবং এর উৎপত্তি নিয়ে আইনস্টাইন এর ধারনাটা আলোচনা করছিলাম।কিন্তু এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এর পক্ষে প্রমান দরকার। এইটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার যে আসলেই বস্তুর ভর তার চারপাশের স্থান-কালকে বাকিয়ে দেয় কিনা? আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি তে ১৯১৫ সালে তিনি এই ধারনাটা প্রথম উপস্থাপন করেন। তখন খুব অল্পসংখ্যক মানুষ ছাড়া কেউ এই তত্ত্বকে স্বীকার করেনি।অর্থাত্ এটি প্রমাণ করার দরকার ছিল। কিন্তু বাহ্যিকভাবে আমরা এটাকে প্রমাণ করার কোনো উপায়ই দেখিনা। তাই এটিকে প্রমাণ করার জন্য এই স্থান কালের সংকোচন থেকেই একটি তত্ত্ব সামনে এলো,একে বলা হয় গ্যাভিটেশনাল লেন্সিং।
চিত্রে আমাদের সৌরজগত, এবং সুর্যের পিছনে একটি অন্য নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। এখন নক্ষত্রটি যেহেতু সুর্যের ঠিক পিছনে,তাই আমাদের এটা দেখার কথা নয়?নক্ষত্রটা জলন্ত, অর্থাত্ এর আলো আমাদের দিকে আসছে,সরলপথে। কিন্তু মাঝখানে সুর্যের অতিরিক্ত ভরের কারনে স্থান-কাল বেঁকে গেছে।অর্থাত্ পিছনের নক্ষত্রটির আলো এইপর্যন্ত এসে এরপর বেঁকে যাওয়ার কথা।অর্থাত্ নক্ষত্রটি পৃথিবীর সোজাসুজি না হলেও আমরা এর আলো দেখা উচিত?? সত্যিকার অর্থে তাই হয়,কিন্তু সুর্যের অতিরিক্ত আলোর কারনে এই আলো আমরা দেখতে পাইনা। কিন্তু আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রমান করার জন্য এটা জরুরি!আমাদের যেকোনো ভাবেই হোক,পিছনের নক্ষত্রটাকে দেখতেই হবে। ঠিক এটাই হয় ১৯১৯ সালে সুর্যগ্রহনের সময়। চাঁদ এবং সুর্য একই সরলরেখায় চলে আসার কারনে চাঁদের কারনে সুর্য আধারে ঢেকে যাওয়াকে সুর্যগ্রহন বলে। গ্রহনের মাঝামাঝি সময়ে যখন সুর্য চাঁদ দ্বারা সম্পুর্ন ঢেকে যায় তখন পৃথিবীতে আধার নেমে আসে,আর এই সময়টাই পিছনের নক্ষত্রটাকে দেখার উত্তম সময়!! ১৯১৯ সালে ব্রাজিলে এই ঘটনাটিই ঘটে। সুর্য ঢেকে যাওয়ার পর আংশিক আধারে দেখা মিলে কাঙ্ক্ষিত নক্ষত্রটি,প্রমান হয়ে যায় আইনস্টাইন এর আপেক্ষিক তত্ত্ব। মহাকর্ষকে মানুষ নতুন করে চিনতে শুরু করে। যেই মানুষটি এই পরীক্ষাটি সম্পন্ন করেছিলেন তার নাম হলো স্যার আর্থার এডিংটন।