এক লোকের ইচ্ছা ছিল তিনি বর্তমানের মহাকাশ গবেষণাকে আরো সাশ্রয়ী করবেন-তাই তিনি স্পেস এক্স(SpaceEx) প্রতিষ্ঠা করলেন।তার আবার ইচ্ছা হলো তিনি পরিবেশ দুষনরোধী বৈদ্যুতিক গাড়ি চালাবেন-তিনি তেসলা মোটরস প্রতিষ্ঠা করলেন। তার দ্রুত গতিতে ট্রেনে ভ্রমণ করার স্বপ্ন ছিল-তিনি হাইপারলুপ (দ্রুতগতির যোগাযোগ প্রযুক্তি) প্রতিষ্ঠা করছেন। শুধু এতটুকুই নয়,বর্তমান সময়ের ইন্টারনেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় টাকা লেনদেনের মাধ্যম পেপাল(PayPal),সৌরশক্তির ব্যাবহার করে বিশ্ব বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখা সোলারসিটি(SolerCity),কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা সংস্থা (OpenAI) ইত্যাদির ফাউন্ডার বা কো-ফাউন্ডার ও তিনিই। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি?হ্যাঁ, আমি বর্তমান দুনিয়ার বিস্ময়,প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী ও বিজনেস টাইকুন ইলন মাস্ক(Elon Musk) এর কথা বলছি।চলুন এই ভদ্রলোক সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য জেনে নেই।
জন্ম এবং বাল্যকাল: ইলন মাস্কের জন্ম জুন ২৮ ১৯৭১,সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে।জন্মগতভাবে আফ্রিকান হলেও তিনি মোট তিনটি দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। আফ্রিকা,কানাডা এবং আমেরিকা।বর্তমানে তিনি আমেরিকাতে অবস্থান করছেন।তার মা একজন কানাডিয়ান মডেল এবং বাবা একজন সাউথ আফ্রিকান ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।জন্মের পর ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি আফ্রিকায় ছিলেন। এরপর কানাডায় চলে আসেন।ইলন মাস্কের ছেলেবেলাটা কিছুটা বৈচিত্র্যময়।নয় বছর বয়সেই তার বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো।মাত্র বার বছর বয়সেই নিজে নিজে পোগ্রামিং শিখেছিলেন ইবং একটি ভিডিও গেমসও বানিয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন:মাস্ক ছোটবেলায় বাবার সাথে আফ্রিকায় থাকাকালীন সেখানকার স্থানীয় বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ালেখা করেন। বয়স ১৮ বছরের কাছাকাছি হওয়ার সময় তিনি কানাডাতে চলে আসেন এবং সেখানে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। মা কানাডিয়ান হওয়ার সুবাদে তিনিও কানাডার নাগরিকত্ব পেয়ে যান।কুইন্সে দুই বছর থাকার পর তিনি ইউনিভার্সিটি অফ পেনিসিলভ্যানিয়াতে চলে আসেন।১৯৯৭ সালে এখান থেকে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন এবং ওয়ার্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিকসেও ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ এ মাস্ক আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসেন এবং সেখান থেকে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০২ সালে মাস্ক আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন।
ব্যাবসায় যাত্রা এবং ক্যারিয়ার:মাস্কের ব্যাবসায়ী হওয়ার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে তিনি এবং তার ভাই মিলে Zip2 নামের একটি ওয়েব সফটওয়্যার কোম্পানির মাধ্যমে।তিনি কোম্পানিতে ৭% শেয়ারের মালিক ছিলেন।১৯৯৯ সালে তিনি X.com নামে একটি ইন্টারনেট ভিত্তিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেম চালু করেন যাকে আমরা বর্তমানে পেপাল(PayPal) নামে চিনি।এটি বর্তমানে ইন্টারনেট ভিত্তিক টাকা লেনদেনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।২০০২ সালে পেপাল eBay কিনে নেয় প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। স্পেস এক্স এবং তেসলা,মহাকাশপথ এবং সড়কপথ দুটোর ভবিষ্যতই বদলে দেয় যে কোম্পানিগুলো:মাস্কের ছোটবেলা থেকেই পৃথিবীর ভবিষ্যত বদলে দেওয়া এবং একে দীর্ঘদিন বসবাসযোগ্য করার স্বপ্ন ছিল। তিনি এমন গুটিকয়েক মানুষদের একজন যারা পৃথিবীর নিকটবর্তী দুর্যোগকে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরন কমানো,স্বল্পমুল্যে মহাকাশ যাত্রা,মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদিই ছিল তার স্বপ্ন। এবং অবাক করার বিষয় হলো তিনি এসবই বাস্তবায়ন করে চলেছেন অনেকটা গোপনীয়ত ভাবেই।২০০২ এর মে মাসে যাত্রা শুরু করে রকেট তৈরি এবং উৎক্ষেপন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স।স্পেস এক্সের তৈরি রকেটগুলো প্রচলিত রকেটের চাইতে অনেকগুন বেশী সস্তা এবং কার্যকরীতার দিক দিয়ে এক নম্বরে অবস্থান করছে।বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ সংস্থা এবং আমেরিকার সরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা(NASA)র স্পেস এক্স এর সাথে চুক্তি রয়েছে।ফ্যালকন ১,৯ স্পেস এক্সের বিখ্যাত রকেটসমুহ। ২০০৩ সালের জুলাইয়ে যাত্রা শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণকারী কোম্পানি তেসলা মোটরস।যদি কোম্পানির শুরুতে মাস্ক ছিলেন না।২০০৪ সালে মাস্ক এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগদান করেন। মাস্ক তেসলাতে যোগদান করার পর কোম্পানিটি নতুন করে যাত্রা শুরু করে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।২০০৮ সালে তেসলা রোডস্টার এর একটি এডিশন বিশ্বের ৩১ টি দেশে ২৫০০ ইউনিট বিক্রি হয়।২০১৪ তে ঘোষণা দেয় যে এর যেকোনো টেকনোলজির প্যাটেন্ট যে কেউ ভালো কাজে ব্যাবহার করতে পারবে। ২০১৬ তে মাস্ক Tesla.com ডোমেইনটি একজন ব্যাক্তির কাছ থেকে কিনে নেন যার কাছে ডোমেইন নেমটি প্রায় ২৪ বছর ধরে ছিল। সোলারসিটি:২০০৬ সালে ইলন এবং তার দুই কাজিন মিলে গড়ে তোলেন সৌর বিদ্যুত উৎপাদনকারী কোম্পানি সোলারসিটি।২০১৩ সালে এটি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম সৌরশক্তি ব্যাবহার করে বিদ্যুত উৎপাদনকারী সংস্থা ছিল।২০১৬তে মাস্ক এটিকে সম্পুর্ন তেসলার অধীনে নিয়ে আসেন। এছাড়াও ইলন মাস্ক আরো যেসব সংস্থা এবং গবেষণার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত আছেন-
হাইপারলুপ:দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যাবস্থা। ক্যাপসুল এর মতো দেখতে এই যান বর্তমানের রেলগাড়িগুলোর তুলনায় অনেক দ্রুত ভ্রমন করতে পারে।
ওপেন এ আই(OpenAI):কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান।২০১৫ এর শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে।
নিউরালিঙ্ক:স্নায়ুবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা।২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে।
দ্যা বোরিং কোম্পানি:মাস্ক যখন দেখলেন যে রোজ ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে আমাদের জীবনের মুল্যবান সময়গুলো নষ্ট হচ্ছে তখন তিনি একটি টানেল নির্মাণকারী কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন।
ব্যাক্তিগত জীবন:ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক আলোচনা হলো,এবার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলা যাক।ব্যাক্তিগত জীবনে মাস্ক ততটা সুবিধার নন।বিয়ে করেছেন দুইটি।দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেই দুইবার!মানে মোট তিনবার!!মাস্ক ২০০০ সালে প্রথম বিয়ে করেন এবং ছয় সন্তানের বাবা হন।তাদের প্রথম সন্তান জন্মের ১০সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়।২০০৮ সালে তিনি তার প্রথম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স করেন এবং ব্রিটিশ অভিনেত্রী টালুয়াহ রিলির সাথে প্রেম করেন।২০১০ সালে তাদের বিয়ে হয়।কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়।২০১৩ তে তারা আবার বিয়ে করেন এবং ১৪ তে আবার ডিভোর্স করেন!!!২০১৬তে মাস্ক এক আমেরিকান অভিনেত্রীর সাথে ডেটিং শুরু করেন কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
তিনি মাস্ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান যারা বিধ্বস্ত এরিয়াতে বিনামূল্যে সৌরশক্তি সরবরাহ করে থাকে।মাস্ক তেসলা সাইন্স সেন্টার নির্মাণে ১ মিলিয়ন ডলার দান করেন এবং ফিউচার অফ লাইফ ইন্সটিটিউটে ১০ মিলিয়ন ডলার দান করেন।
ধর্ম এবং এলিয়েনে বিশ্বাস:মাস্ক ব্যাক্তিগতভাবে নিজেকে বিধর্মী দাবি করেন।তিনি এটাও বলেন যে তিনি কখনো ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করেন না।যদিও স্পেস এক্সের প্রথম ফ্যালকন রকেট উৎক্ষেপনের সময় নাকি তিনি প্রার্থনা করেছিলেন।তিনি জোড়ালোভাবে এলিয়েনে বিশ্বাস করেন। এবং পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও হয়তো জিবীত প্রানি থাকতে পারে এ মতামত প্রকাশ করেন।
ইলন মাস্ক সম্পর্কে আরো কিছু অজানা তথ্য:-
১।বাস্তবজগতের টনি স্কার্ক:-ইলন মাস্ক অনেকটাই আয়রনম্যানের টনি স্টার্ক থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।আয়রন টুয়ে তার ক্যামিও আছে,এমনকি আয়রনম্যান টু ফিল্মটির কিছু অংশ তার স্পেস এক্সের ভিতরে দৃশ্যায়িত হয়েছিলো।
২।অ্যাপলের স্টিভ জবসের মতোই তেসলা মোটরসে মাস্কেরও বার্ষিক বেতন ছিল মাত্র ১ ডলার!
৩।মাত্র ১২ বছর বয়সেই মাস্ক একটি ভিডিও গেমস তৈরী করেন এবং ৫০০ ডলারে বিক্রি করেন।
৪।মহাকাশ যাত্রাকে মাস্ক এতটাই সস্তা করেছেন যে এর খরচ এখন আগের থেকে ৯০% এর মতো কমে এসেছে।
৫।২০১৬ সালে মাস্ক ফরচুন ম্যাগাজিনের দ্বারা ১৩’এর সেরা বিজনেসম্যান নির্বাচিত হন।
৬।মাস্কের বাবা-মা ছোটকালে ভাবতেন তাদের ছেলে বুঝি বধির!কারন দুর থেকে ডাকলে তিনি সাড়া দিতেন না।
৭।ছোটবেলায় তিনি তার স্কুলের ছাত্রদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিলেন।এমনকি তিনি একবার মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
৮।তিনি বিশ্বাস করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।এ নিয়ে হালের উন্নত রোবট সোফিয়ার সাথে তার একটি মজার ঘটনাও আছে।সোফিয়ার মন্তব্য তিনি নাকি অতিরিক্ত হলিউড মুভি দেখায় তার এমন মনে হচ্ছে!!!
আরো অনেক কিছুই লেখার ছিল।সময় এবং ধৈর্যের কাছে হেরে গিয়ে এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখলাম।যা লিখলাম তাও কম নয়!আজকে এতটুকুই,সামনে আরো আর্টিকেল নিয়ে হাজির হবো।
তথসুত্র:-
www.wikipedia.com
www.inc.com
www.entrepreneur.com
www.facebook.com