জাতীয় পতাকার ডিজাইনার কে ? পাঠ্যপুস্তকে সেই ছোটবেলা থেকেই পড়ে এসেছি পটুয়া কামরুল হাসানের নাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নতুন করে জানতে পারলাম উপেক্ষিত এক ‘শিবনারায়ণ দাস’ এর নাম। জানার পর থেকেই মানুষটাকে জানার প্রবল আগ্রহ জাগে মনের ভেতর।
আমাদের জাতীয় পতাকা নিয়ে কামরুল হাসানের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, তাই বলে শিবনারায়ণ দাসকে বেমালুম ভুলে যাওয়া কি উচিত? নাকি তিনি নিজেকে জনসমক্ষে ফলাও করে উপস্থাপন করেন না বলে, ইতিহাসের পাতা থেকে ‘শিবনারায়ণ দাস’ নামটাই মুছে ফেলা উচিত ?
‘শিবনারায়ণ দাস’ নামটা এদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা, অপরিচিত এক মুখ। খুব কম সংখ্যক মানুষই এই নামের সঙ্গে পরিচিত। এ কম সংখ্যক মানুষও আবার কমে আসছে। তবে আজ বিজয় দিবসে এই মানুষটার সম্পর্কে কিছু না লিখলেই নয়।
১৯৪৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, টঙ্গীবাড়ি উপজেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিবনারায়ণ দাাসর বাবার নাম সতীশ চন্দ্র দাশ, পেশায় ছিলেন একজন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। শিবনারায়ণ দাস ছিলেন কুমিল্লা জেলা স্বুলের ছাত্র, তবে অজানা এক কারণে জেলা স্বুল থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পরেননি। পরের বছর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বিএ পাস করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে নেন এম এ ডিগ্রি।
১৯৭০ সালের ৭ই জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। সেই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারী ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা সেই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
সেই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাস, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে সোনালি হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল) এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে রেখাচিত্র নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিবনারায়ণ দাস তার নিপুন হাতে সোনালি হলুদ মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো ‘ফেব্রুয়ারী ১৫ বাহিনী’র পতাকা, যা কিছুদিন পর স্বীকৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সারা বাংলায় পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইন করা সেই পতাকা উত্তোলিত হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটুয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
তবে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করা শিবনারায়ণ দাসকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে গত ৪৪ বছরেও জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে তো নয়ই ! মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দান করার অপরাধে পাক হানাদাররা শিবনারায়ণ দাসকে খুঁজে না পেয়ে শিবনারায়ণ দাশের বাবা সতীশ চন্দ্র দাশকে গাড়ির সাথে বেঁধে নিয়ে গুলি করে মেরেছিল। আজ পর্যন্ত বাবার লাশটিও খুঁজে পাননি হতভাগ্য শিবনারায়ণ দাশ।
লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না।